রবিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪ | ১৫ বৈশাখ ১৪৩১

Weekly Bangladesh নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত
নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত

একজন একনায়কের সঙ্গে বিমান ভ্রমণ

আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু   |   বৃহস্পতিবার, ০৭ মার্চ ২০২৪

একজন একনায়কের সঙ্গে বিমান ভ্রমণ

আমার সাত দশকের জীবনে চার জন সামরিক একনায়ক কর্তৃক শাসিত হয়েছি: — জেনারেল ফিল্ড মার্শাল মোহাম্মদ আইয়ুব খান, জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান, লেফটেন্যান্ট জেনারেল জিয়াউর রহমান এবং লেফটেন্যান্ট জেনারেল হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ। শেষোক্ত দুই একনায়ককে দেখার ও তাদের সঙ্গে করমর্দনের এবং সর্বশেষ জনের সঙ্গে সংক্ষিপ্ত বিমান ভ্রমণের ও তিনি ক্ষমতার গগন থেকে ছিটকে পড়ার পর তার সঙ্গে আমার দীর্ঘ আলাপচারিতার সুযোগ হয়েছে। ব্যক্তিত্ব, শিক্ষা ও অভিজ্ঞতার দিক থেকে চারজনের জনের মধ্যে কোনো মিল ছিল না।
জেনারেল মোহাম্মদ আইয়ুব খান আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন। তিনি ব্রিটিশ রয়েল মিলিটারি কলেজ, স্যান্ডহার্স্টের ক্যাডেট ছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বার্মা-আসাম ফ্রন্টে জাপানি বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন। ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় তিনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
জেনারেল ইয়াহিয়া খান অবিভক্ত ভারতে দেরাদুনে কর্নেল ব্রাউন কেমব্রিজ স্কুল ও পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইরাক, ইটালি ও উত্তর আফ্রিকায় নিয়োজিত ছিলেন। ১৯৪২ সালে মুসোলিনীর নেতৃত্বাধীন ইটালির বাহিনীর হাতে বন্দি হয়ে যুদ্ধবন্দি শিবিরে আটক থাকাকালে তৃতীয় প্রচেষ্টায় তিনি পালাতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধে তিনি ভারতের বিরুদ্ধে কাশ্মিরে পাকিস্তান সেনাবাহিনী পরিচালনা করেন।
লেফটেন্যান্ট জিয়াউর রহমান করাচির একাডেমি স্কুলে এবং ডি,জে সিন্ধ গভর্নমেন্ট সায়েন্স কলেজে পড়াশোনার পর পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে খেমকারান সেক্টরে ভারতীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে বীরত্ব প্রদর্শন করায় পাকিস্তানের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সামরিক পদক “হিলাল-ই-জু’রাত”, তিনটি “সিতারা-ই-জু’রাত” ও আটটি “তমঘা-ই-জু’রাত” পদক লাভ করেন। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ তিনি পাকিস্তানি শাসনের বিরুদ্ধে প্রথম বিদ্রোহ ঘোষণা করেন এবং আনুষ্ঠানিকভাবে বেতারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। তিনি ‘জেড ফোর্সের’ প্রধান হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। কোনো যুদ্ধে অংশগ্রহণের রেকর্ড নেই কেবল এরশাদের। তবে তিনি রংপুর কারমাইকেল কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন এবং সামরিক জীবনে বিদেশে কিছু কোর্সে অ্যাটেন্ড করেছেন।
এই চার সামরিক নেতা ও রাষ্ট্রপ্রধানের মধ্যে আইয়ুব খান, জিয়াউর রহমান ও হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ রাজনৈতিক দল গঠন করেছিলেন, প্রত্যেকে নিজ নিজ দলের প্রধান হয়েছিলেন, প্রত্যেকে তাদের ক্ষমতাকে বৈধ করার উদ্দেশ্যে ক্ষমতায় থেকে নির্বাচন করেছেন এবং “বিপুল ভোটে” জয়যুক্ত হয়েছেন। তাদের দলগুলোর নাম ছিল যথাক্রমে পাকিস্তান মুসলিম লীগ (কনভেনশন), বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ও জাতীয় পার্টি (জেপি)। ব্যতিক্রম ছিলেন শুধু জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান। তিনি কোনো রাজনৈতিক দল গঠন করেননি বা কোনো দলকে পৃষ্ঠপোষকতাও করেননি। তিনি ১৯৭০ সালে পাকিস্তানের স্বাধীনতার ইতিহাসে প্রথমবারের মতো সর্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে (তখন ২১ বছর বয়সীরাই কেবল ভোটার হতে পারতো) জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করেন। এ নির্বাচনেও কারচুপি ছিল, তা সত্ত্বেও এ যাবতকালে পূর্ব পাকিস্তানে এবং বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলোর মধ্যে এটি সবচেয়ে সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ বিবেচিত।
এই চার সামরিক একনায়কের মধ্যে মাত্র দু’জন জেনারেল মোহাম্মদ আইয়ুব খান এবং লেফটেন্যান্ট জেনারেল জিয়াউর রহমানের বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতির অভিযোগ ছিল না। তাদের বিরুদ্ধে মদ্যপান ও নারী লিপ্সার অভিযোগ বা এ ধরনের অভ্যাসের গুজবও শোনা যায়নি। কিন্তু ইয়াহিয়া খান ও এরশাদের বিরুদ্ধে মদ্যপান ও বহু নারীকে শয্যাশায়ী করা “ওপেন সিক্রেট” ছিল। তবে এ ক্ষেত্রেও দু’জনের মধ্যে ছিল বিরাট পার্থক্য। মদ্যপানে ইয়াহিয়া খান পাকিস্তানের সকল শাসককে অতিক্রম করেছিলেন, নারী সঙ্গ উপভোগে এরশাদের রেকর্ড পাকিস্তান বা বাংলাদেশে আর কোনো শাসক ভাঙতে পারেনি।
মদ্য পানে ইয়াহিয়া খান এত খোলামেলা ছিলেন যে, তিনি ১৯৬৯ সালের ২৫ মার্চ প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের কাছ থেকে দায়িত্ব গ্রহণ করে প্রথমে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক এবং ৩১ মার্চ থেকে প্রেসিডেন্ট হিসেবেও দায়িত্ব গ্রহণ করার পর ওই বছরের ২৪ এপ্রিল তিনি প্রথমবারের মতো পূর্ব পাকিস্তান সফরে এলে ঢাকা সফরে এলে পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক আইন প্রশাসক মেজর জেনারেল মুজাফফরউদ্দিন গভর্নর’স হাউজে প্রেসিডেন্টের সম্মানে নৈশভোজে আয়োজন করেন। মোনায়েম খান যখন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর, তখন তিনি গভর্নর’স হাউজের কোনো অনুষ্ঠানে মদ্য পরিবেশন নিষিদ্ধ করেছিলেন। গভর্নর হিসেবে তার সাড়ে ছয় বছর মেয়াদে এর ব্যত্যয় ঘটেনি। সেজন্য মেজর জেনারেল মুজাফফরউদ্দিন দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন যে, প্রেসিডেন্টের সম্মানে মদ পরিবেশন করবেন কিনা। ইয়াহিয়া খানকে এ বিষয়ে একটু ইঙ্গিত দেওয়ার পর তিনি রায় দেন, “সবাই জানে, আমি মদ পান করি। এ নিয়ে এত রাখঢাক করার কি আছে?”
একইভাবে লে: জেনারেল এরশাদের নারীপ্রীতিতেও কোনো রাখঢাক ছিল না। তিনি দুনীতিপরায়ণও ছিলেন এবং উভয় বদগুণের উপস্থিতির কারণে তিনি সমালোচিত হলেও, তিনি এসবের তোয়াক্কা করতেন বলে মনে হয় না। এমনকি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো পর্যন্ত তাকে “ওয়ান অফ দ্য ওয়ার্ল্ডস মোস্ট স্ক্যান্ডাল-প্রুফ ডেসপটস” অর্থ্যাৎ “বিশ্বের অন্যতম সেরা কেলেঙ্কারি-সহিষ্ণু স্বৈরশাসক” অভিধায় ভূষিত করেছিল। কথিত ছিল, কোনো সুন্দরী নারীর প্রতি তিনি আকৃষ্ট হলে, তাকে প্রলুব্ধ করে হোক বা অন্য কোনো উপায়ের হোক, অর্থ্যাৎ ‘ছলে বলে কৌশলে’ তাকে শয্যাগত করতেন।
প্রেসিডেন্ট পদের একটি মাহাত্ম তো অবশ্যই ছিল, যার শয্যায় যেতে অনেক নারী যে আগ্রহী ছিল, এমন ভাবাটাও অন্যায্য হবে না। পাশ্চাত্য সমাজে ওপরের পর্যায়ের লোকদের যৌন সম্পর্ক এবং অসম বিবাহ নিয়ে প্রশ্ন করতে সাংবাদিকরা দ্বিধা করেন না। ইরানের পরাক্রমশালী শাহনাশাহ রেজা পাহলবীর নারীসঙ্গ এবং তার প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য বৈবাহিক সম্পর্ক নিয়ে ইটালির খ্যাতিমান সাংবাদিক ওরিয়ানা ফালাচি তাকে বলেছিলেন, “পারস্যের একজন সম্রাট, যিনি নারীর সঙ্গে সম্পর্কের কারণে সবসময় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু, সে তো স্বয়ং আপনি।” একই সাংবাদিক সাইপ্রাসের প্রেসিডেন্ট আর্চবিশপ ম্যাকারিয়াসকে বলেছেন, “গুজব রয়েছে যে, একজন শ্রদ্ধেয় যাজক হয়েও আপনি বহু নারীতে আসক্ত। এটা কি সত্য নয় যে, নারী আপনার প্রিয়?” প্রেসিডেন্ট এরশাদকেও কোনো বিদেশি সাংবাদিক তার নারী সংসর্গ সম্পর্কে প্রশ্ন করলে তিনি ব্রিবত বোধ করার পরিবর্তে উত্তর দিয়েছিলেন, “হোয়াট’স রং এবাউট ইট। আই অ্যাম ফিট ফর দ্যাট। আই হ্যাভ অ্যা স্পোর্টিং বডি।” মাশাআল্লাহ! এই না হলে প্রেসিডেন্ট!
এরশাদ সম্পর্কে সুনির্দিষ্টভাবে বলা হয় যে, মেরি মমতাজ, বিদিশার সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্কের বাইরেও সেনা বাহিনী প্রধান ও প্রেসিডেন্ট হিসেবে তার মেয়াদে আরও অন্তত ১৮জন নারীর সঙ্গে তার শারীরিক সম্পর্ক ছিল এবং এইসব নারীর অধিকাংশই ছিলেন তার বিভিন্ন পর্যায়ের সহকর্মীদের সুদর্শনা স্ত্রীগণ। যারাই তাদের নিজেদের বা স্বামীদের কোনো কাজের তদবীরের জন্য প্রেসিডেন্টের কাছে যেতেন, মহামান্য প্রেসিডেন্ট তাদের আরাধ্য কাজের জন্য সুপারিশ বা অনুমোদন দান করা ছাড়াও তাদেরকে ধন্য করতেন তার শয্যাসঙ্গীনি করে।
এরশাদের মেয়াদে ১৯৮৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তার দল জাতীয় পার্টি ২৫১ আসনে বিজয় লাভ করে। ত্রিশটি সংরক্ষিত নারী আসনে যে ৩০ জন নারীকে মনোনীত করা হয়, তাদের অধিকাংশই প্রেসিডেন্ট এরশাদের বাহুলগ্না হওয়ার জন্য “অধিক আগ্রহী” ছিলেন বলে জানা যায়। এ মর্মে খ্যাতিমান সাংবাদিক শফিক রেহমান তার সম্পাদিত বহুল আলোচ্য ও জনপ্রিয় সাপ্তাহিক “যায় যায় দিন” এ একটি ব্যঙ্গ-রসাত্মক কভার স্টোরি করলে এরশাদ সাহেব রুষ্ট হন, ‘যায় যায় দিন’ এর প্রকাশনা নিষিদ্ধ হয় এবং শফিক রেহমান তড়িঘড়ি দেশত্যাগ করে সে যাত্রা রক্ষা পান।
প্রেসিডেন্ট এরশাদের একটি গুণ ছিল, তা হলো, তার কবিতা ও কবি প্রীতি। তিনি মোগল সম্রাট ও ভারতীয় নওয়াব ও রাজা মহারাজাদের কায়দায় দেশের বেশ কিছু শীর্ষস্থানীয় কবিকে তার সভা কবি হিসেবে স্থান দেন। তাদের মধ্যে সৈয়দ আলী আহসান, সানাউল্লাহ নূরী, আল মাহমুদ, ফজল শাহাবুদ্দীনের এবং আমলা-কবি মনজুরে মাওলা’র নাম অগ্রগন্য। এরশাদ সাহেব মাঝে মধ্যে কবিতাও রচনা করতেন এবং কবি সমাবেশে “কবি” হিসেবে সম্বোধিত হতে ভালোবাসতেন। কারণ তারও কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল এবং সরকারি দৈনিকে তার কবিতা ছাপা হচ্ছিল পত্রিকাটির ‘প্রথম পৃষ্ঠায়’। সভাকবিরা এরশাদের কবিতা পাঠ করে তার কাব্য প্রতিভায় ধন্য ধন্য করতেন। এসব কবিকে তিনি যথেষ্ট সম্মান ও আনুকূল্য দান করেন গুলশানে আবাসিক প্লট বরাদ্দ দিয়ে। কিছু সাংবাদিকও তার আশীর্বাদে সিক্ত ও ধন্য হয়েছিলেন, তাদের মধ্যে তোয়াব খান, শফিক রেহমান, এমনকি নামেমাত্র সংবাদপত্র দৈনিক শক্তি সম্পাদক একিউএম জয়নুল আবেদিনও ছিলেন। তারাও প্রেসিডেন্টের বদান্যতায়, গুলশানে আবাসিক প্লট ও তেজগাঁও এ শিল্প প্লটের বরাদ্দ লাভে ধন্য হয়েছিলেন।
এ তালিকায় আরো খ্যাতিমান কবি ও সাংবাদিক আছেন, দীর্ঘদিনের ব্যবধানে যাদের নাম আমি স্মরণ করতে পারি না। এসব সভাকবি ও চামচা সাংবাদিকগণ এরশাদের নারী আসক্তিকে তেমন দোষনীয় বলে গন্য করতেন না, বরং তারা বলার চেষ্টা করতেন যে, “রাজা-বাদশাহদের মধ্যে এসব থাকেই!” তাছাড়া এরশাদ নিজেও দাবি করতেন যে নারীকে পরিতৃপ্ত করার মতো দৈহিক সক্ষমতা তার বিদ্যমান। ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর তার বিরুদ্ধে আনীত অসংখ্য অপরাধের তালিকায় তিনি কবিতা লিখতে চৌর্যবৃত্তির আশ্রয় গ্রহণ করেছিলেন বলেও একটি অপরাধ সংঘটনের একটি অভিযোগও ছিল।
প্রেসিডেন্ট পদ থেকে উৎখাত এবং কারাগার থেকে মুক্ত হওয়ার পর এরশাদ সাহেবের “লিবিডো” বা যৌন তাড়না সম্ভবত বেড়ে যায়। তবে দীর্ঘ কারাবাসে নারী সংসর্গ থেকে বঞ্চিত থাকার কারণে তার সক্ষমতা হ্রাস পাওয়া অস্বাভাবিক কিছু ছিল না। কথায় বলে “অনভ্যাসে বিদ্যা নাশ” অথবা লোহা ব্যবহার না করে ফেলে রাখলে তাতে জং ধরা অনিবার্য। সাবেক প্রেসিডেন্টেরও সম্ভবত তাই ঘটেছিল, যাকে চিকিৎসা শাস্ত্রে বলা হয় “লো লিবিডো” বা “যৌন তাড়না হ্রাস” অথবা “ইরেকটাইল ডিজফাংকশন” বা “উত্থান সমস্যা”। এসব সমস্যা দূরীকরণে আমেরিকায় তখন সদ্য বাজারজাত হয়েছে “ভায়াগ্রা” নামক বটিকা, যা সেবনে উপরোক্ত সমস্যায় আক্রান্তরাও নাকি ব্যাঘ্রের মতো শক্তিশালী হয়ে উঠে। বিখ্যাত উর্দু কবি মীর তকি মীরের ভাষায় “পালং তোড়” বা খাট ভাঙার ক্ষমতা সৃষ্টি হয়।
বাংলাদেশের একমাত্র ট্যাবলয়েড দৈনিক মানবজমিন বিশ্বস্ত সূত্রে জানতে পারে যে সাবেক প্রেসিডেন্ট ভায়াগ্রা সেবন করতে শুরু করেছেন। কত দামে, কোন দেশ থেকে তার জন্য ভায়াগ্রা আনা হয়েছে — এ সব তথ্য সমৃদ্ধ একটি রিপোর্ট সম্ভবত ১৯৯৯ সালের প্রথম দিকে প্রকাশিত হয়। রিপোর্টটি প্রকাশিত হওয়ার পর একদল সুঠামদেহী ব্যক্তি মানবজমিন অফিসে হামলা চালিয়ে ভাংচুর করে এবং সাংবাদিক কর্মচারিদের হুমকি দিয়ে যায়। তখনো সাবেক প্রেসিডেন্টের ব্যক্তিগত দেহরক্ষী দলে অনেক সাবেক সৈনিক নিয়োজিত ছিল। সন্দেহ করা হয় যে, তারাই ভাংচুর করতে ও হুমকি দিতে এসেছিল।
ভিন্ন একটি প্রসঙ্গের অবতারণা করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু ওপরের ঘটনাগুলো মনে পড়ায় তা না লিখলে ভুলে যেতে পারি বলে অপ্রাসঙ্গিক হওয়া সত্ত্বেও উপস্থাপন করলাম। সাংবাদিকতা পেশায় আমার দীর্ঘ চার দশকে আমি কখনো কোনো প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী, এমনকি কোনো মন্ত্রীর সফরসঙ্গী হয়ে বিদেশ ভ্রমণ করিনি। এজন্য প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল, রিপোর্টিংয়ে আমার যৎসামান্য যোগ্যতা এবং
আমার দুই দশকের সম্পাদকের সঙ্গে আমার মানসিক দূরত্ব, যিনি এমনকি আমার বিটের বিদেশ সফরগুলোতে তার প্রিয়ভাজনদের নমিনেট করতে পছন্দ করতেন। এজন্য আমার দু:খবোধ তেমন ছিল না। কারণ বিভিন্ন সময়ে আমার বিদেশ ভ্রমণকালে বিমানে উঠার পর অনেক মন্ত্রীর সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ ঘটেছে। মন্ত্রী মহোদয়ের পিএস’রা বিজনেস ক্লাস থেকে ইকনমি ক্লাসে আমার কাছে এসে মন্ত্রী মহোদয়গণের সফরসূচি বর্ণনা করতেন। আমি এতে বিমলানন্দ উপভোগ করতাম। ওইসব পিএসদের একাধিকজন মন্ত্রীপরিষদ সচিব, অবসরের পর রাষ্ট্রদূত বা কোনো আন্তর্জাতিক সংস্থায় দায়িত্ব পালন করেছেন এবং আমার সঙ্গে বন্ধুত্বের সম্পর্ক বজায় রাখতে ভোলেননি। ওইসব ঘটনায় অনেক ক্ষেত্রে এমনও দেখা গেছে, তারা যে কর্মসূচিতে যাচ্ছেন, আমিও একই কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করতে যাচ্ছি। অনুষ্ঠানস্থলেও তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছে। ভোজ অনুষ্ঠানে ভিন্ন ভিন্ন টেবিলে বসেছি।
একমাত্র ব্যতিক্রম ঘটেছে প্রেসিডেন্ট এরশাদের সঙ্গে এবং দেশের অভ্যন্তরে। ১৯৮৭ সালের সম্ভবত অক্টোবর মাসে চট্টগ্রাম ইউরিয়া ফার্টিলাইজার কারখানা আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়। উদ্বোধন করবেন প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ। ঢাকা থেকে যেসব রিপোর্টার প্রেসিডেন্টে সঙ্গে যাবেন, আমিও তাদের একজন ছিলাম। প্রেস ক্লাব থেকে আমাদের নিয়ে তথ্য অধিদফতরের (পিআইডি) মাইক্রোবাস বিমানবন্দরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলেও যান্ত্রিক গোলযোগে সেটি রাস্তায় থেমে যায়। আমাদের নিয়ে যাওয়ার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত পিআইডি’র ডেপুটি প্রিন্সিপাল ইনফরমেশন অফিসার দেওয়ান সাহেব (পুরো নাম মনে নেই) ঘামতে শুরু করেছেন। মাইক্রোবাস চলার উপযোগী করতে ড্রাইভারের আধা ঘন্টা লেগে গিয়েছিল। আমরা যখন বিমানবন্দরে পৌছলাম, তখন নিরাপত্তা বিষয়ক পরীক্ষা নিরীক্ষার প্রক্রিয়া অনুসরণ করলে নির্ঘাত ফ্লাইট মিস হবে।
ওই সময় বিমানবন্দরে পৃথক অভ্যন্তরীণ টার্মিনাল ছিল না। বিমাবন্দরের মূল টার্মিনাল ভবনের উত্তর দিকে একটি গেট ছিল অনুমোদিত যানবাহনের টারমাকে প্রবেশের জন্য। এজন্য পৃথক পাস প্রয়োজন হতো। আমাদের বহনকারী পিআইডি’র মাইক্রোবাসের সেই পাস ছিল না। দেওয়ান সাহেব ড্রাইভারকে বললেন সেই গেট দিয়ে প্রবেশ করতে। নিরাপত্তা রক্ষী বাধা দিল কিন্ত দেওয়ান সাহেবের ধমকে ও গাড়িটি সরকারি দেখে ছেড়ে দিল। টারমাকের এক কোণায় চট্টগ্রামে উদ্দ্যেশে ছেড়ে যাওয়ার জন্য এফ ২৮ ফকার ফ্রেন্ডশিপ বিমান প্রস্তুত। সিঁড়ি খুলে নেওয়া হয়েছে। বিমানের দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। যেহেতু বিমানের আরোহী দেশের প্রেসিডেন্ট, অতএব বিমানের আশপাশে বেসামরিক পোশাকে সিকিউরিটির বেশ কিছু সদস্য দাঁড়িয়ে আছেন।
মাইক্রোবাস বিমানের অতি নিকটে না নিতে তাদের ইশারা করার কারণে মাইক্রোবাস থামলো। কয়েকজন এগিয়ে এসে মাইক্রোবাস ঘিরে ধরলেন। আমরা নামলাম। আমরা প্রেসিডেন্টের সফরসঙ্গী বলার পরও তারা তাদের যুক্তিতে অনড়। প্রেসিডেন্টের কোনো ফ্লাইটে এভাবে আরোহণ করা সম্ভব নয়। তাদের যুক্তি অত্যন্ত সঙ্গত। তিনি বললেন, প্রেসিডেন্ট অনুমতি দিলেই কেবল তা সম্ভব। আমাদের মধ্যে সিনিয়র ছিলেন ইত্তেফাকের জাহিদুজ্জামান ফারুক। তিনি অত্যন্ত সজ্জন মানুষ ছিলেন, সবসময় মুখে হাসি লেগে থাকতো। কিন্তু চটে গেলে তাকে সামাল দেওয়া কঠিন ছিল। তিনি সিকিউরিটির লোকজনকে ধমকাতে শুরু করলেন। বিতণ্ডার মধ্যেই সিকিউরিটির কেউ ওয়াকিটকিতে বিমানের অভ্যন্তরে প্রেসিডেন্টের প্রধান নিরাপত্তা অফিসারের সঙ্গে কথা বললেন। তিনি হয়তো প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কথা বলেছেন। আবার সিড়ি এসে বিমানে লাগলো, বিমানের দরজা খোলা হলো। আমরা বিমানে আরোহণ করলাম।
দরজা দিয়ে ঢুকেই বাম পাশের প্রথম আসনে প্রেসিডেন্ট এরশাদ একা বসেছেন। এক সারি আসন খুলে তার আসনের সামনে একটি টি-টেবিল বসানো হয়েছে। বিভিন্ন দৈনিক সংবাদপত্র ও নিউজউইক, টাইম ম্যাগাজিন রাখা টেবিলে। প্রেসিডেন্ট অমায়িক ব্যক্তি, জাহিদুজ্জামান ফারুককে দেখে মুখ তুলে জানতে চাইলেন, ‘কি ব্যাপার, জাহিদুজ্জামান, আপনাদের দেরি হলো কেন?’ জাহিদুজ্জামান ফারুক বললেন, “স্যার, রাস্তায় গাড়ি বিকল হয়ে গিয়েছিল।” বিমানের সব যাত্রী মন্ত্রী, সচিব, অতিরিক্ত সচিব, বাংলাদেশ কেমিকেল ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশনের উর্ধতন কর্মকর্তা, সিকিউরিটির সদস্য এবং যেহেতু চীনের অর্থায়নে কারখানাটি নির্মিত হয়েছে, সেজন্য কিছু চাইনিজ চেহারার লোকজন। সামনের দিকে আমাদের সংরক্ষিত আসনগুলোতে অন্যেরা বসেছিলেন। সিকিউরিটি প্রধান তাদের অনুরোধ করলেন আসনগুলো ছেড়ে দিতে। তারা উঠে পেছনের দিকে চলে গেলে আমরা বসলাম।
আকাশপথে ঢাকা-চট্টগ্রাম চল্লিশ-পয়তাল্লিশ মিনিটের সংক্ষিপ্ত ভ্রমণ হলেও বাংলাদেশ বিমান কর্তৃপক্ষ সম্ভবত নারী সৌন্দর্যের ‘পরওয়ানা’ (পতঙ্গ) প্রেসিডেন্টের সেবার জন্য দু’জন সুন্দরী এয়ার হোস্টেসকে এই ফ্লাইটে এসাইন করেছে। আমরা সাংবাদিক প্রতিনিধিরা মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছিলাম। কামনা করছিলাম, মেয়ে দুটি বিমান পর্যন্তই প্রেসিডেন্টের দৃষ্টিপথের পথিক হয়ে থাকুক এবং তার অন্তর্ভেদী এক্স-রে দৃষ্টি তাদের শরীর আবিস্কার না করুক।
বিমানের দরজা বন্ধ হলো। আস্তে আস্তে এগিয়ে গেল রানওয়ের দিকে। একজন একনায়কের সঙ্গে আকাশে উড়লাম।


advertisement

Posted ১১:২৯ অপরাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ০৭ মার্চ ২০২৪

Weekly Bangladesh |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

গল্প : দুই বোন
গল্প : দুই বোন

(6292 বার পঠিত)

স্মরণে যাতনা
স্মরণে যাতনা

(1309 বার পঠিত)

মানব পাচার কেন
মানব পাচার কেন

(1154 বার পঠিত)

advertisement
advertisement
advertisement

এ বিভাগের আরও খবর

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
 
১০১১১২১৩
১৪১৫১৬১৭১৮১৯২০
২১২২২৩২৪২৫২৬২৭
২৮২৯৩০  
Dr. Mohammed Wazed A Khan, President & Editor
Anwar Hossain Manju, Advisor, Editorial Board
Corporate Office

85-59 168 Street, Jamaica, NY 11432

Tel: 718-523-6299 Fax: 718-206-2579

E-mail: [email protected]

Web: weeklybangladeshusa.com

Facebook: fb/weeklybangladeshusa.com

Mohammed Dinaj Khan,
Vice President
Florida Office

1610 NW 3rd Street
Deerfield Beach, FL 33442

Jackson Heights Office

37-55, 72 Street, Jackson Heights, NY 11372, Tel: 718-255-1158

Published by News Bangladesh Inc.